শেষ যাত্রার শুরুতে


কেস স্টাডি ১ঃ

মৃত্যুটা হয়েছিলো একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে। মৃতের সারা শরীরে অসংখ্য কাঁচ ঢুকে গিয়েছিলো। শয়ে শয়ে, নাকি হাজারে হাজারে? গোসল করানোর জন্য তার গায়ে হাত দেয়া যাচ্ছিলো না। কী করণীয়? অনেক চিন্তার পর একটা বুদ্ধি বের হলো। কীভাবে মনে নেই কিন্তু আলগোছে লাশটাকে আধ শোয়া করে পানির পাইপ দিয়ে তীব্র বেগে বিপরীত দিক থেকে পানি বর্ষণ করা হতে লাগলো। কিছুটা গাছে পানি দেয়ার মত করে। বেশ দূর থেকে আর খেয়াল করা হলো সামনে যেন কেউ না থাকে। সেই পানির তোরে অজস্র কাঁচ বেড়িয়ে এলো শরীর থেকে। এভাবে বেশ কয়েক বার করার পর অবস্থা অন্তত এটুক দাঁড়ালো যে গায়ে হাত দেয়া যাচ্ছে, কোনো রকমে গোসল সেরে কাফনের কাপড় পরিয়ে দেয়া হল।

কেস স্টাডি ২ঃ

মেয়েটা হাল ফ্যাশনের টাইট জিন্স আর টপস পরে বের হয়েছিলো বাসা থেকে। এবার একটু বেশিই আঁটসাঁট কেনা হয়ে গেছে কী? নাহ, যত লেগে থাকে গায়ের সাথে, বডি শেপটা ভালো বুঝা যায়, সুন্দরও লাগে—রিকশায় বসে ভাবছিলো মেয়েটি। কিন্তু বাধ সাধলো বিপরীত দিক থেকে তীব্র বেগে ছুটে আসা একটা বাস। রিকশা থেকে ছিটকে পরলো। গোসল করানোর সময় দেখা গেলো এত সাধের জিন্সটা এমনভাবে গায়ের সাথে এটে বসেছে যে কিছুতেই লাশের গা থেকে খোলা যাচ্ছে না। কী করণীয় তবে? বহু কষ্টে পায়ের গোড়ালি থেকে কাঁচি দিয়ে কাটা শুরু করা হল। শরীরের মাংস যেন কেটে না যায় এইভাবে, অতি সাবধানে জিন্সটা গা থেকে খোলা হল, গোসল দেয়া হল।

কেস স্টাডি ৩ঃ

‘আমার খুব ভয় লাগছে রে’—ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে বোনকে ফিসফিস করে বলেছিলো মেয়েটি। যদি এবারো মেয়ে হয়, তোর দুলাভাই বলেছে যেন তার বাড়ির চৌকাঠ না মারাই।

আহ আপা, এত ভাবিস না তো, রিযিক্বের মালিক আল্লাহ। যেতে হবে না তোর ওই বাসায় তিন নাম্বার মেয়েকে নিয়ে।

সাত পাঁচ এত না ভেবেই বড় বোনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো। কিন্তু সে কি বুঝেছিলো কী বলেছিলো বোনকে?

আলট্রা সনোগ্রামে দেখা গেলো এবারো মেয়ে। বাড়ি ফিরে স্বামীকে কী বলবে এটা ভাবতে ভাবতেই ডাক্তারের চেম্বারে সিড়ি দিয়ে হোঁচট খেয়ে পরল মেয়েটি। কয়েক স্টেপ গড়িয়ে যখন নিচে পরল, তখন সব শেষ। আপাদমস্তক বোরখাতে আবৃত, সুন্দরভাবে তার রাবের কাছে চলে গেলো মেয়েটি, সাথে গর্ভের মেয়েটাও। আর একজন মেয়ে জন্ম দেয়ার ‘বিশাল’ অপরাধের শাস্তি পেতে হল না আর। মেয়েটিকে গোসল করানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো যার, তিনি বলেছিলেন এত সহজ আর সুন্দরভাবে খুব কম গোসলই সম্পন্ন হয়েছে। হাল্কা একটা হাসি মুখে লেগেছিলো যেন ঠোঁটে। অপমানজনকভাবে কোনো বাড়িতে ফিরতে হয় নি, ফিরে গেছেন সম্মানজনক এক বাড়িতে।

কেস স্টাডি ৪ঃ

উনার পরিচিত কেউ নেই? আত্মীয় স্বজন?

নাহ, এই নার্সিং হোমে ফেলে গেছে দিন দশেক আগে, ভুয়া ফোন নম্বর আর ঠিকানা দেয়া। গত ৪-৫ ঘণ্টা ধরে পায়ুপথ দিয়ে বর্জ্য পদার্থ বের হচ্ছে তো হচ্ছেই। এমনিতে গোসল করাতে গিয়ে মৃতের শরীর থেকে রক্ত, জমে থাকা মলমূত্র বের হওয়া কিছুটা কমন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এহেন ঘটনার সম্মুখীন হন নাই কখনো। বিরামহীনভাবে বের হয়ে চলেছে। আর ধৈর্য ধরে রাখা সম্ভব হল না……… মোটামুটিভাবে গোসল শেষ করিয়ে এক গাদা তুলার গাড্ডি চেপে ধরা হল ওই রাস্তায়। এভাবেই কাফনের কাপড় পরিয়ে ফেলা হল………


উপরের ঘটনাগুলো ২০১০-১১ সাল নাগাদ একটা লাশ ধোয়ানোর ক্লাস করতে গিয়ে ইন্সট্রাক্টরের মুখে শোনা। বিস্তারিত এখন অনেকটাই মনে নেই, তাই কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তবে মূল থিম ঠিক আছে। যিনি ক্লাস নিয়েছিলেন, এই জীবনে বহু লাশ ধুইয়েছেন তিনি। হয়েছেন বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী। আমাদের সারা জীবনের যা আমল, অনেক সময়েই তার উপর নির্ভর করে এই শেষ যাত্রার শুরুটা কেমন হবে। কারো কারো গোসল করাতে গিয়ে বীভৎস সব অভিজ্ঞতা হয়, কারো কারো ক্ষেত্রে খুব সহজে, সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়ে যায় সব কিছু। পরিচয় প্রকাশ না করে এই অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করেছিলেন যেন আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

ওই ক্লাস করার পর বেশ কিছুদিন রাতে ঘুমাতে পারতাম না। দুআ করতাম একটা সুন্দর মৃত্যুর জন্য। তারপর কত সময় কেটে গেছে। শয়তান ভুলিয়ে দিয়েছে ওই তীব্র আবেগ।

আবারো হয়তো দুআর লিস্টে যোগ হয়েছে হালাল ইনকাম, পড়াশোনা, সন্তান, সবার সুস্থ থাকা……… সবই গ্রহণযোগ্য দুআ অবশ্যই কিন্তু একটু বেশিই বুঝি দুনিয়াকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলাম?

জানি না।


গতকাল আমার নানী শ্বাশুড়ি আমাদের রাবের কাছে ফিরে গেছেন। আমার দেখা অসাধারণ একজন মহিলা। অসামান্য সুন্দর উনার চেহারা মনে করলেই আমার চোখে ভেসে উঠে একটা দৃশ্য…….. আশেপাশের মহিলারা হয়তো সাংসারিক নানা আলাপচারিতায় মগ্ন, উনি একটু দূরে বসে তাফসীর পড়ছেন। আমাদের বিয়েতে তাফসীর ইবনে কাসীরের পুরো সেটটা গিফট দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন একজন আত্মীয়কে। উনার বক্তব্য ছিলো এইটা আমাদের সবার পড়া দরকার, এই সুযোগে কেনা হয়ে যাবে, সবাই মিলে মিশে পড়া যাবে।

শেষ যেবার দেশে যাই, উনার সাথে কয়েক রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিলো। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতাম বিছানা খালি, তাহাজ্জুদের জন্য উঠে গেছেন। আমি উনার অনেক আদর পেয়েছি, ভালবাসতে পারার অসামান্য যে ক্ষমতা আল্লাহ উনাকে দিয়েছিলেন, তার বদৌলতে। শেষ কদিন খুব কষ্ট পেয়েছেন………. ক্যান্সারে ভুগছিলেন। উনার কষ্টের দিনগুলো আবার আমার মাঝে ওই দুআটা ফিরিয়ে এনেছে—একটা সুন্দর মৃত্যুর দুআ।

যখন আমি আমার রাবের প্রতি সন্তুষ্ট এবং আমার রাব, আম্মা, মেয়ের বাবা, আমার চারপাশের মানুষগুলো আমার উপর সন্তুষ্ট, এই অবস্থায় যেন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে পারি। এই যে নানু চলে গেলেন, উনার চারপাশের মানুষগুলো শুধুই স্মরণ করছেন উনার ওয়াক্তের শুরুতে নামায পরার, তাহাজ্জুদ পরার, গীবত না করার, কুরআন বুঝে পড়ার, পর্দা করে চলার অভ্যাসগুলো। আল্লাহ আমাদেরও এমন মৃত্যু দেয়ার তৌফিক দিন, নানুকে জান্নাতুল ফিরদাউস দিন, আমাদের, আমাদের সন্তানদের উনার জন্য সাদক্বায়ে জারিয়ে হিসেবে ক্ববুল করুন।


১. উত্তম মৃত্যুর জন্যে দোয়া 🌹

‎*اللهم إني أسألك حسن الخاتمة .. *
উচ্চারণ: আল্লহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুসনাল খ-তিমাহ।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উত্তম মৃত্যু চাই!

২. মৃত্যুর আগে খাঁটি তাওবা করার জন্য দোয়া🌹

‎اللهم أرزقني توبة
‎ نصوحة قبل الموت
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মারযুক্বনি তওবাতান্নাসু-হাহ, ক্ববলাল মাউত।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রিযিক হিসেবে দিন মৃত্যুর পূর্বে খাটি দিলে তওবা করার।

৩. দ্বীনের উপরে অটল থাকার জন্য দোয়া 🌹

‎.. اللهم يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك ..
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইয়া! মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, ছাব্বিত ক্বলবী আ’লা দ্বীনিক।
অর্থ: হে আল্লাহ! হে হৃদয়ের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার হৃদয়কে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন!