ঔদাসিন্যে চিন্তাবিদ্ধ এইসব দিনরাত্রি


অদ্ভুত সব দিন কেটে যাচ্ছে। ক্রমাগত… ইদানিং একদম লিখতে ইচ্ছে করেনা। একটা তীব্র অনিচ্ছা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। একটা তীব্র অনাগ্রহ আমাকে ক্রমাগত উদাসীন করে চলেছে সবকিছুর প্রতি… তারই একটা ধকল হয়ত ‘না লেখালেখি’। অথচ কিছু ভাবনা যে আমাকে যন্ত্রণাদগ্ধ করেনা, তা না। বরং বিপরীতটাই হচ্ছে। অনেক রকমের ‘আনসলভড থিংকিং’ আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছে!

ব্লগার হতে হলে লিখতে হয়, লেখা পড়তে হয়, কমেন্টের উত্তর দিতে হয়, আবার কমেন্ট করে আসতে হয়। অথচ আমি এতটাই অন্যরকম মতন হয়ে গেছি– আমি প্রায় কয়েকবার করে আমার ব্লগের কমেন্টগুলো পড়েছি। সহৃদয় পাঠকগণ আমাকে তাদের সুচিন্তিত মন্তব্যগুলো, ব্যক্তিগত বার্তা দিয়ে ঋণী করে দিয়ে গেছেন… তবু, উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না। কেন যেন মনে হয় এই প্রতিক্রিয়াটুকুর জন্য যতখানি জীবনীশক্তি লাগে– আমার তা নেই। ক্ষমা চাইতে হলে অন্ততঃ একটা ব্লগ পোস্ট লিখতে হয়– সেটাও ইচ্ছে করেনা। তাকিয়ে তাকিয়ে সবার লেখাগুলি পড়ি– ফেসবুকের নোটে, ব্লগে… আবার কমেন্ট সেকশনে তীব্র বুলি ওড়ে… শুধুই মনে হয়– কী হবে আমার কথাগুলো বলে! প্রিয় ব্লগারদের লেখাগুলো ঠিকই পড়ি, কিছু বলা হয়না…

ফেসবুকে ছবি আপলোড দেখি — নানারকম ফ্যান্সি আইডিয়া– নিজের ছবি, নিজের পরিবারের, গাড়ির, টেবিলের, শার্টের, জামার ছবি, নতুন ঘড়ি সবকিছুর ছবি তুলে জানিয়ে দিতে হবে যেন এই পৃথিবীকে। স্ট্যাটাসে প্রেমের কথোপকথন, কোন বাসের চিপায় কে বসলো, আশেপাশে কারা বসে আছে, কয়টাকা দিয়ে পিজাহাটে খেলো, সেখানে ছবি তুলে আপলোড করে দেয়া– সব কেমন যেন ‘অতিপ্রকাশ’ লাগে। কোন ফ্রাইড চিকেনটা ‘অসাম’, কোন ‘লেগরোস্ট’ জোশশ… কোন কার গাড়িটার ‘কমফোর্ট’ বেশি ছিলো, নতুন মোবাইল কেমন আর ছবি– সবই শুধু অন্যকে জানিয়ে দেয়া… আকাশে তুলে দেয়া দরকার নিজের সমস্তটাই! নিজের একান্ত বলে কি কিছু নাই? ক্রমশঃ নিজেকেই অবাস্তব লাগে। হয়ত আমিই ব্যাকডেটেড আর অযোগ্য– তাই এই প্রজন্মের সবার প্রকাশভঙ্গির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে জানিনা।

ইউনিভার্সিটিতে গল্প করার লোক খুঁজে পেতাম কম। নারী, মুভি, টাকা, ক্যারিয়ার ছাপিয়ে কথা বলার লোক পেতে একটু পরিশ্রম করতে হতো বৈকি! সেই তখনকার সময়ে গাঁজার আসরে বুঁদ হয়ে বসে থাকতে দেখতাম যেসব ছেলেদের, যাদের সাথে আড্ডা দিয়েছি ঘন্টার পর ঘণ্টা, জীবনে কোনই আদর্শ বলতে কেউ ছিলোনা তাদের– যেই ছেলে কয়টা কোনদিনই কোন বই পড়ে নাই– হঠাৎ দেখলাম তারা জ্ঞানী হয়ে গেলো। ফেসবুকের পাতা ভরা তাদের স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস আর বিভিন্ন ধর্মের লিমিটেশনের নজির লেখা, ইসলামই মূল লক্ষ্য। নব্য জ্ঞানী লোকের লেখা দেখে পড়তে যাই, নতুন কী কী ‘প্রমাণ’ এলো! হুবহু এই লেখাগুলোই ব্লগ জগতে দেখেছি অনেক, ফেসবুকের নোটে পড়েছি সর্বদাই… ছেলেগুলো নতুন করে শিখলো! এই লোকদের গালিবহুল কমেন্ট সেকশনে ভদ্র মানুষের টেকা দায়। তবু আগ্রহী হয়ে সব পড়ি, প্রতিটি অক্ষর! অনেকেই দেখি সেখানে যান– তাদের ধর্মের পক্ষে বুঝাতে চান। যিনি ঠিক করেই ফেলেছেন তিনি জগতের ‘প্রকৃত রহস্য’ বুঝে গেছেন, তিনি বিজ্ঞান দ্বারা ‘সমস্ত’ কিছুর ‘যুক্তি’ বের হবে বলে ‘অপেক্ষায়’ আছেন– তাকে ঠেকায় এমন সাধ্য কার? কিন্তু আমি তো জানি, এ সবই নিজের ভোগকে (উপভোগ নয়) সম্পূর্ণ ‘সঠিক’ করে প্রকাশিত করার একটা চেষ্টা মাত্র। যখন ধর্মীয় বাঁধন তাদের কর্মকান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে– তখনই এই ‘জ্ঞানের’ প্রকাশ ও তর্কের সূচনা হয় নিজেকে ‘বিবেকের দংশন’ থেকে মুক্তি দিতে… বাকিটা জীবনভোর চালিয়ে যাওয়া আরকি!

সৃষ্টিজগতের রহস্য বের করবেন ‘হকিন্স’, সেই অপেক্ষায় থাকবেন যারা, তাদের দলে কীভাবে সামিল হবো? রহস্য উদঘাটনকারীরা নিজেরাই নশ্বর, প্রতিবন্ধী। তারা জগতের রহস্য উদঘাটন করে নিজেরাই সীমাবদ্ধতায় ভরপুর। এই জগতের এই সভ্যতার আগে হাজার হাজার কোটি বছরে কোন ‘ডারউইন হকিন্স’ ছিলেন না? শুধু বলতে ইচ্ছে করে– মানুষ কেন মরে? এই আপনি যখন নেটে বসে আনন্দ করতেসেন, তখন কেন একটা বস্তিতে একটা ছেলে রোগে কাত হয়ে শুয়ে থাকে চৌকিতে। কেন ইয়ুরোপের ছেলেগুলো তখন গাড়িতে চড়ে ‘রাইডে’ যায়? কেন কাশ্মীর আর ফিলিস্তিনে চোখের সামনে বাবার আর ভাইয়ের মৃত্যু দেখতে হয় নিষ্পাপ কন্যাশিশুদের? পারবেন আপনার “যুক্তি” দিয়ে এটাকে বুঝাইতে? হে বিশ্বের জ্ঞানীতম চিন্তাবিদেরা– নিয়ে আসো এদের একই প্ল্যাটফর্মে। চলে যাওয়া নিরপরাধ আত্মাদেরকেও নিয়ে আসো (যদি তোমাদের যুক্তি দিয়ে কিছু বের করতে পারো) তবে সাধ্য থাকলে এই কাজটাও করো।

পত্রিকাতে রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত মিথ্যাচার সেই ছেলেবেলা থেকে দেখছি। অনেক অনেক নেতারই ব্যক্তিগত জীবন জানতে পেরেছি একদম কাছের লোকদের মাধ্যমে। যারা দেশের ‘উন্নতি’ ভাসিয়ে দিয়ে চলেন, তাদের পারিবারিক ঘটনা আর ব্যক্তিগত চরিত্রের কথাগুলো জানার পর আমার কেমন যেন কার্টুন লাগে! নিজের প্রতি করুণা হয়। ইভটিজিং সামলাতে হলে নাকি ‘কারাতে’ শিখতে হবে মেয়েদের! ইভটিজিং নিয়ে দেশের থিঙ্কট্যাংক শিক্ষকগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটা সেমিনারে ‘আবিষ্কার’ করলেন ধর্মীয় ‘আগ্রসন’ এই ইভটিজিং-এর মূলে! নতুন করে নির্বাক হই।

প্রতিদিন হত্যা-ধর্ষণ-লুট দেখি। মেয়েদের প্রতি পাশবিক আচরণগুলো দেখি… যৌতুকের জন্য, দ্বিতীয় বিয়েতে অমতের জন্য, বিয়েতে রাজি না হবার জন্য, প্রেমে অমতের জন্য… আমরা মানুষ!!

বাজারে গিয়ে ১১২ টাকা কেজি সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে মনে হয়– “তবু আমরা বেঁচে আছি!”

রিকশায় চলা ২৬ মিনিটের পথে যখন বাসে দাঁড়িয়ে সিদ্ধ হয়ে ১ ঘন্টা ৪৪ মিনিট পর নামি রাস্তাতে– তখন মনে হয় “আমরা আজো বেঁচেই আছি”! ৪০ টাকা কেজি চালের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভাবি– এভাবেই বেঁচে থাকা হয়!

বন্ধুর বাসায় গিয়ে স্যাটেলাইটের চ্যানেল বদলাতে গিয়ে দেখলাম স্টার প্লাসে মুসলিম চেহারার (ওসামা বিন লাদেনের মতন) একজনকে নিয়ে একটা কমেডি চলছে। অপেক্ষা করে দেখলাম সেখানে অতি স্বল্পবসনা একজন নারীও আছেন পাশে। আবুল সেই মুসলিমকে নারী অভিনেত্রী বললেন অমুক কাজটা করবা? আরব্য পোশাকের লম্বা দাড়িওয়ালা সেই পুরুষ ঝাঁপ দিয়ে বললো তোমার জন্য আমি সব পারি (ব্যাকগ্রাউন্ডে হাসির শব্দ)। মুসলিমরা খুব ঢিলা! আবার চ্যানেল বদলে দিলাম। স্টার মুভিজ– লেখা আফগানিস্তান– পাহাড়ে একজন ক্যামেরাম্যান ছবি তুলছে– মাথায় টুপি আর হাতে স্টেনগানওয়ালাদের– সবাই সন্ত্রাসী… জগতের সন্ত্রাস আর ‘ফানি’ চরিত্র মুসলিমদেরই!

দেশীয় চ্যানেলগুলোতে জানলাম এবারের লাক্স ফটোসুন্দরীরা নিজেদের ডিজাইনে নিজেরা সাজবেন। তাদের কিছু ক্যাটওয়াক দেখলাম। অসাধারণ শিল্পশৈলীর (!!) পোশাক দেখলাম। তারপর শাহবাগের মোড়ে একটা বিলবোর্ডে একজন স্বল্পবসনা মডেলকে দেখে আগ্রহী হয়ে বুঝতে পারলাম এটা ফার্নিচারের। বাস থেকে নেমে একজন বৃদ্ধাকে পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখলাম। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি… জিজ্ঞেস করে জানলাম তার কেউ নেই…

ক্রমাগত বৈচিত্র্য দেখি জীবনের। জীবন ধারণ করা মানুষগুলো কী চায় বুঝতে পারিনা। অবিমিশ্র ‘উপভোগ’ কীভাবে এই জীবনে করা সম্ভব, অন্ততঃ করতে ‘চাওয়া’ সম্ভব তাও বুঝিনা। নিজেকে খুব অজ্ঞ লাগে, নিজের প্রতি করুণা হয়, বেঁচে থাকাটাকে সহস্র কেজির মতন ভারসদৃশ লাগে… আর ভয় হয়! পৃথিবী আর পরকালে পরাজিত হওয়া একজন সৈনিক বলে মনে হয়… এই শঙ্কাকে দূর করতে পারছি না কিছুতেই।

দিগন্তে হেলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই জীবনের একটা হিসেব করতে ইচ্ছে হয়। জানি এই হিসেব কখনই লেজারের হিসেবের মতন ডেবিট-ক্রেডিট মিলিয়ে সমান সমান করে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না… এভাবেই একদিন চলে যাবো সব ছেড়ে। তখনই সমস্ত রহস্যের উত্তর জেনে নেবো নাহয়!


[০৫ ডিসেম্বর, ২০১০]