“আমার কিছু জানার নেই”


দেখা করতে এসে কোনও ভূমিকা ভনিতা ছাড়াই বলল, আপনি ছিলেন না, তাই দাওয়াত দিতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল আপনিই আমার বিয়েটা পড়াবেন। তাকদীরে ছিল না। আপনাকে একবার আমার শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে।

ছেলেটি সহজ সরল। মাদরাসার শিক্ষক। মা নেই। ঘরে বৃদ্ধ বাবা আছেন। ভাইয়েরা যে যার মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বিয়ের গল্প শুনতে চাইলাম। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,

কোনও গল্প নেই। পড়াশোনা শেষ। মাদরাসায় খেদমতের ব্যবস্থা হয়েছে। মাদরাসা থেকে প্রতিমাসে যে সম্মানী দেয়া হয়, হিসেব করে দেখলাম, সে টাকায় আমি আর বৃদ্ধ বাবা ছাড়া কষ্টেসৃষ্টে আরও একজনের চালডালের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিয়ের দোয়া শুরু করলাম।

একজন খোঁজ দিল, ওমুক ছাত্রের উপযুক্ত বোন আছেন। দাওরা পাশ করেছেন। এখন ঘরে থাকেন। হিফজ করার খুব শখ। তার ইচ্ছা, বিয়ের আগে হিফজ শেষ করবেন। বাবার কাছেই হিফজ করছেন। মায়ের সাথে ঘরের কাজ শিখছেন। মেয়ের বাবা প্রত্যন্ত এক গাঁয়ের গরীব মাদরাসা শিক্ষক।

মাদরাসার মাসিক ছুটিতে ওই ছাত্রের সাথে তার বাড়ি চলে গেলাম। ছাত্রকে কিছু না বললেও, সে বোধ হয় কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। পৌঁছতে পৌঁছতে এশা হয়ে গেল। ছাত্রের বাবার সাথে মসজিদেই দেখা। তিনি অবাক হলেও মুখ ফুটে কিছু বললেন না। হয়তো ভেবেছেন, ছেলে নিজের ওস্তাদকে বাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছে।

ছেলের ওস্তাদ। তাই অত্যন্ত আদব-এহতেরামের সাথে সালাম-মুসাফা করলেন। আমার প্রতি তার আদব দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তিনি বয়েসে পিতৃতুল্য। আলিম হিসেবেও অত্যন্ত জাইয়িদ। আমরা কথা বলছিলাম মসজিদের বারান্দায় বসে।

কুশল বিনিময়ের পর, আমার পরিবারের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরলাম। লাজ-সংকোচ ঝেড়ে সরাসরি বিয়ের কথায় চলে এলাম। বললাম,

– আপনি মেহেরবানি করে কিছু মনে না করলে, আপনার কাছে একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই।

তিনি আলিম আর অভিজ্ঞ মানুষ। আমার প্রস্তাব কী হতে পারে তিনি টের পেয়ে গেলেন। মুচকি হেসে বললেন,

– আপত্তি থাকবে কেন, আপনি বলুন।

অভয় পেয়ে বললাম, আপনার সাথে ‘সিহরী (صِهْرِي) আত্মীয়তার বন্ধনে জুড়তে পারলে, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।

আমার কথা শুনে তিনি শুধু বললেন, আপনি কি এস্তেখারা করেই এসেছেন?

– জ্বি।

আচ্ছা, ঠিক আছে আমি দুইরাকাত এস্তেখারার নামাজ পড়ে নিই।

তিনি উঠে মসজিদের ভেতরে চলে গেলেন। আমিও নামাজ দাঁড়ালাম। সিজদায়, শেষ বৈঠকে মনপ্রাণ খুলে দোয়া করলাম। রাব্বে কারীম যেন খাইরের ফয়সালা করেন। নামাজ শেষ করে মুরুব্বী এসে বললেন,

– আপনি কষ্ট করে এখানে একটু তাশরীফ রাখেন। মেহমান বাইরে বসিয়ে রাখা বেআদবি। আমি ঘরে যাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না। আমাদের ঘরটা ছোট আর ভাঙা। চট করে মেহমান নিয়ে যেতে পারি না। তাই একটু গুছিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবো।

ছাত্র এতক্ষণ অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা যাওয়ার সময় বলে গেলেন, সে যেন আমাকে সঙ্গ দেয়। আমরা কথা বলছি। একটু পরেই বাবা এলেন। পরম আদরে ঘরে বসতে দিলেন। ছেলেকে নাশতা আনতে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। বাবা বললেন,

– আমি মেয়ে আর মেয়ের মায়ের সাথে কথা বলেছি। মেয়ে বলেছে, আমি যা ভাল মনে করি। মেয়ের মা একটু আপত্তি করলেও, সেটা তেমন কিছু নয়। আগে থেকে বলে আসলে, প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যেত। এজন্যই আপত্তি। আপনি কি আমার মেয়ের সাথে একটু কথা বলবেন?

আমি তো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি যেন। আবেগ সামলে বললাম,

– আপনার মেহেরবানি।

তিনি উঠে চলে গেলেন। একটু পর বাবা আর ভাই নাশতা নিয়ে এলেন। পেছন পেছন লাজনম্র পায়ে ‘তিনি’। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বসেছিলাম পালঙ্কের উপর। ঘরে চেয়ার টেবিল নেই। ছাত্র নাশতা রেখে দৌড়ে গিয়ে একটা ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এল। ‘উনি’ জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসলেন। চেয়ারের পায়া বোধহয় ভাঙা। তাই ভাই পেছন থেকে চেয়ার ধরে রেখেছে।

বাবা আমাদের দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর তিনি উঠে চলে গেলেন। আমি আর কী বলব। মানুষটার লজ্জা, সংকোচ, মাথা নিচু করে বসে থাকা দেখে মনে কী এক আবেগ, মহব্বত আর মায়ার জোয়ার উথলে উঠল যেন। আমি শুধু বললাম,

– আপনার যদি কিছু জানার থাকে, বলুন।

তিনি মাথা নেড়ে জানালেন, তার জানার কিছু নেই। আমি বললাম,

– আমারও জানার কিছু নেই। আমার জন্য দোয়া করবেন। আরেকটি কথা, শুনেছি আপনার হাফেজ হওয়ার খুব ইচ্ছা। আমি কথা দিচ্ছি, আল্লাহর পক্ষ থেকে এখানে বিয়ের ফয়সালা হলে, হাফেজ হওয়ার জন্য আপনাকে আমি জানপ্রাণ দিয়ে সাহায্য করব।

একথা বলার পর, খেয়াল করলাম, তার মুখে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। তিনি এই প্রথমবারের মতো আমার দিকে চোখ তুলে চাইলেন। সাথে সাথেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। তার চোখে ক্ষণিকের প্রসন্ন দৃষ্টি দেখে মন বলে উঠল, আমি বোধহয় পরীক্ষায় উতরে গেছি। আল্লাহ সহায়।

ছাত্রকে ইশারা দিয়ে বললাম, বোনকে নিয়ে যেতে। তারা চলে গেল। আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। জীবনে এই প্রথম কোনও অপরিচিতা মেয়েকে এত কাছ থেকে দেখলাম। কথা বললাম। কেন যেন ভীষণ খুশিতে ভেতরটা টগবগ করতে লাগল। পাশাপাশি আশংকাও হচ্ছিল। যদি রাজি না হয়? একটু পর ‘বাবা’ এলেন। তিনি জানতে চাইলেন, আমার বাবার সাথে কথা বলে এসেছি কি না?

– জ্বি, আব্বাকে জানিয়েই সবকিছু করি।
– আপনার আব্বার সাথে একটু কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে?
– অবশ্যই।

আমি আব্বাকে কল দিলাম। তিনি শুয়ে পড়েছিলেন। অল্পকথায় সব জানালাম। দুই মুরুব্বীর কথা হল। কথা শেষ করে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। একটু পর এসে বললেন,

– আপনাকে আপন করে নিতে, আমাদের কোনও আপত্তি নেই।

আবেগ সামলে শুকরিয়া আদায় করে বললাম,

– আকদ কি আজ হওয়া সম্ভব?
– আপনার আব্বা যদি দোয়া করেন, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে কোনও আপত্তি নেই। তবে, আমাদের ঘরটা মেয়ে বিয়ে দেয়ার উপযুক্ত নয়। বিয়েতে খরচ করার মতো আমার হাতে কোনও টাকা-পয়সাও নেই। ঘর মেরামত করার জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। ঘরটা মেরামত করে কয়েকদিন পরে বিয়ের এন্তেজাম করলে করলে কেমন হয়?

আমি আবারও একটু বেলাজ হলাম। বললাম,

– আমার ঘর লাগবে না। আমাদের কেউ ঘর দেখবেও না। আগামীকাল আব্বা আসবেন। যদি কিছু মনে না করেন, ঘর মেরামতের টাকা থেকে মেহমানদারির জন্য ব্যয় করা যেতে পারে।

তিনি মুসকি হেসে বললেন,

– আচ্ছা, ঠিক আছে।

তিনি উঠে চলে গেলেন। এই ফাঁকে আব্বাকে ফোন করলাম। তিনি মনখুলে দোয়া করলেন। দোয়া করতে করতে কাঁদলেনও। হয়তো আমার আম্মার কথা মনে পড়েছে। পাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন মুরুব্বী নিয়ে এলেন। বিয়ে হয়ে গেল। খাবারদাবার সারতে সারতে রাত প্রায় একটা। যে রুমে বসেছিলাম, সেখানেই আমাদের দ্বিতীয় মুলাকাত হল।

পরদিন দুপুরের আগে ভাই ও ভগ্নিপতিদের নিয়ে আব্বা এলেন। মায়ের রেখে যাওয়া কিছু গহনা, প্রয়োজনীয় বাজারসদাই নিয়ে এলেন। বিকেলে বিবিকে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। পরদিন শনিবারে মাদরাসায়।

এই ছিল আমার বিয়ের গল্প।